সাহিত্য পাঠের আনন্দ রচনা
ভূমিকা : সাহিত্য মানবমনের চিরকালের মুক্তি - সরােবর , অনির্বচনীয় আনন্দের ভাণ্ডার । সাহিত্যে সেই অনিবচনীয় সুধা কবি - সাহিত্যিকের হৃদয়ে আসে হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতাে , ক্রমে তা পাঠকের হৃদয় গহনে ঠাই করে নেয় , যুগ যুগ ধরে আনন্দের ধারা বইয়ে দেয় । সাহিত্য পাঠে মনের কলুষ - কালিমা লোপ পায় । সাহিত্য পাঠের চেয়ে মহৎ আনন্দ আর নেই । একনিষ্ঠ পাঠকের পক্ষেই কেবল এ আনন্দ উপভােগ করা সম্ভব । সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করি জগৎ ও জীবনকে , সেই সঙ্গে আমরা উপলদ্ধি করি নিজেকে আমাদের অন্তরের ‘ আমি ’ কে । এই উপলব্ধির আনন্দ অনিঃশেষ ।
সাহিত্যের স্বরূপ ও পাঠ : সাহিত্য ' শব্দটি এসেছে ' সহিত ' শব্দ থেকে । সাহিত্য বলতে বােঝায় সা , সংসর্গ , সাহচর্য বা মিলনকে । সাহিত্যের মধ্যে মিলনের ভাবটি সুস্পষ্ট । সাহিত্য তাই সৃষ্টি করে সংযােগ । মানুষ তার মনের ভাৰ অপরকে জানাবে বলে সাহিত্যের আশ্রয় নেয় । ' অপর ' বলতে সমাজেরই মানুষ , যারা আমাদের সামনে , দূরে সর্বত্র বাস করছে । অর্থাৎ এক মনের সঙ্গে বহু মনের মিলন ঘটানােই সাহিত্যের প্রধান কাজ । আবার যেহেতু ব্যক্তি মানুষও সমাজেরই অঙ্গ , সে কারণে যিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেন তিনি সমাজের একজন হিসেবে সমাজের জন্যেই তা করে থাকেন । সৃষ্টিতে তার ব্যক্তিগত আনন্দ , এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায় , দশ জনকে সেই আনন্দের স্বাদ দেওয়াতেই তার মানসিক তৃপ্তি , কর্মের প্রকৃত সার্থকতা । সাহিত্য রূপের মধ্যে অরূপকে ব্যক্ত করার চেষ্টা , সীমাকে অসীমের পানে বিস্তৃত করার আকুলতা , ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাকুলতা । সাহিত্যিকগণ পাঠকের সামনে তুলে ধরেন সৃষ্টির অমৃত পাত্র , সেই অমৃত পানে পাঠক হৃদয়ে আনন্দের দোলা লাগে । সাহিত্য পাঠে পাঠক অনুভব করেন অধরা মাধুর্যের আনন্দ - স্পর্শ । ব্যক্তিগত দুঃখ - বেদনা , শােক , প্রাত্যহিক জীবনের মালিন্য সাহিত্যের সান্নিধ্যে এসে এক অনন্ত প্রবাহের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় । ব্যক্তির বিশেষ - ভাবনা নির্বিশেষের পানে যাত্রা করে । সাহিত্যিকের ধ্যানী দৃষ্টির সজো পাঠকের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি মিলে আনন্দের ফরুধারা সৃষ্টি হয় ।
সাহিত্য পাঠে অপার্থিব আনন্দ : কবি - সহিত্যিকগণ তাদের রচিত সাহিত্যকর্মে পাঠকের জন্য রচনা করেন আলৌকিক আনন্দের ভার । সানন্দে সে ভার বহন করে পাঠক আনন্দের ধারাস্নানে অভিষিক্ত হন । বিচিত্র কাহিনি , চরিত্র , মাধুর্যমণ্ডিত ভাষা , সর্বোপরি লেখকের চেতনা ও জীবনবােধ পাঠককে ছুঁয়ে যায় । আপন ভাবনা আর লেখকের ভাবনা এ দুইয়ের সমন্বিত রূপে পাঠকের চিত্র বিমােহিত হয় । ফলে সাহিত্যের অমৃত রস পাঠক স্বেচ্ছায় , সানন্দচিত্তে পান করে । সাহিত্য পাঠকের মনের দ্বার খুলে দেয় , পাঠকের হৃদয়কে দাঁড় করায় অপার্থিব আনন্দধারার সামনে । আনন্দই সাহিত্যের আদি , মধ্য ও অন্ত । ফলে সাহিত্য - পাঠে শেষতক আনন্দ লাভ হয় । সে আনন্দ সুখজড়ানাে কিংবা বেদনাঘন দুইই হওয়া সম্ভব । এই জগৎসংসারের আনন্দ - গীতের ঝংকার সাহিত্যের মাধ্যমে পাঠকের অন্তরে ঠাই নেয় । সুখের মতাে ব্যথার আস্বাদে পাঠক আরও বেশি সাহিত্যপ্রেমী হয়ে ওঠে । প্রাত্যহিক জীবনের মলিনতাকে কাটিয়ে নিরঙ্কুশ আনন্দ লাভ সাহিত্য পাঠের দ্বারাই সম্ভব ।
সাহিত্য ও মানবজীবন : সাহিত্য সত্য - সুন্দর - আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠকচিত্তকে আলােড়িত করে । হতাশাগ্রস্ত বিভ্রান্ত মানুষকে পৌছে দেয় জীবনের মহৎ প্রাঙ্গণে । পাষণ্ড প্রাণ আবার নতুন করে খুঁজে পায় মনুষ্যত্ব । সাহিত্য পাঠে তার মধ্যে নতুন জন্মান্তর ঘটে । সাহিত্যই আমাদেরকে অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত করে , মনে আশার আলাে জ্বালায় , স্বপ্ন দেখায় । সাহিত্যের সঙ্গে জীবনকে মিলিয়ে দেখার সুযােগ পেয়ে পাঠক পায় নতুন পথের নির্দেশনা । তাই সাহিত্যের সঙ্গে নিজের মন ও মননকে সংযুক্ত করে উন্নত ও আনন্দপূর্ণ জীবন গঠন করা যায় । সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় মনকে ক্রিয়াশীল রাখতে সাহিত্য পাঠের বিকল্প নেই । জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমন্বয়সাধন হতে পারে সাহিত্যের পাঠ গ্রহণে মাধ্যমে । সাহিত্যের আলাে আমাদেরকে সত্য - মিথ্যা , ভালাে - মন্দ চিনতে ও বুঝতে সহযােগিতা করতে পারে । যদিও জ্ঞান ধারণ ও বিতরণ সাহিত্যের উদ্দেশ্যে নয় , তবু সাহিত্য পাঠ আমাদের অজান্তেই জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয় । সাহিত্যের দার্শনিকতা সমাজকে ইতিবাচক পথে চালিত করে , মানবজীবনকে বিনির্মাণের আনন্দ ও সংহতি দান করে ।
ব্যক্তিত্ববিকাশে সাহিত্য পাঠ : কোনাে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহিত্য পাঠ হতে পারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশল । সাহিত্য পাঠ ব্যক্তির মনুষ্যত্ববােধ জাগরণে ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখে । ব্যক্তির মানসিকতাকে সৃজনশীল ও নিত্য - ক্রিয়াশীল রাখতে সাহিত্যে সান্নিধ্য আবশ্যক । ব্যক্তি তথা পাঠকের মন সমকাল ও সমাজকে আশ্রয় করেই বিকশিত হয় । সাহিত্য পাঠের আনন্দ সার্থক হবে তখনই , যখন একজন পাঠক তা থেকে ব্যক্তিগত জীবনে তাে বটেই , জাতীয় জীবনেও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে । তাই বাস্তবতার নিরিখে অপূর্ণ মানুষ সাহিত্যের মাঝে পূর্ণতার স্বাদ পেতে চায় । একজন পাঠক যখন পাঠে নিমগ্ন থাকে এক ধরনের ধ্যানমগ্নতা তাকে পেয়ে বসে । যে ধ্যানমগ্নতা তাকে আটপৌরে জীবনের দুঃখ - যন্ত্রণার কালিমা থেকে মুক্ত করে মানসিক প্রশান্তি দান করে । পুনঃ পুনঃ এই প্রশান্তি ব্যক্তির চরিত্রকে বদলে দেয় , সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করে উদার ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে ওঠে ।
পাঠোপযােগী সাহিত্য নির্বাচন : সাহিত্য পাঠের আনন্দকে যথার্থ রূপে উপলব্ধি করতে হলে একজন পাঠককে পছন্দসই ও উপযুক্ত সাহিত্য নির্বাচন করা একান্ত জরুরি । নিজ ভাষার সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের চিরায়ত বইসমূহ পাঠ করা একজন সচেতন ও যােগী পাঠকের লক্ষণ । যেসব সাহিত্য - গ্রন্থ পাঠককে ভাবনার নতুন নতুন দ্বার উদ্ঘাটনে সহায়তা করে পাঠের জন্য সে সব সাহিত্য নির্বাচন করা যেতে পারে । সাহিত্য আনন্দের জন্য , সাহিত্য জীবনের জন্য , ফলে নিরানন্দ জীবনে আনন্দ আনার উপযােগী সাহিত্য নির্বাচন করা উচিত । মহাকালের অনন্ত স্রোতধারায় মহাজ্ঞানী - মহাজনেরা তাদের বিচিত্র জীবন - উপাখ্যান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যে সব কালােত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে গেছেন , অনুপম আনন্দ লাভের জন্য সেসব পুস্তক পাঠের জন্য নির্বাচন করা যায় ।
উপসংহার : সাহিত্য পাঠের মতাে নির্মল ও পবিত্র আনন্দ আর নেই । সাহিত্যিকদের মননে অনাগত কালের জীবনই বাণীরূপ লাভ করে । আর তাঁদের রচিত সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আমরা লাভ করতে পারি ভবিষ্যৎ সভ্যতার রূপ - রস - গন্ধের পরিচয় । তাছাড়া অতীত ও বর্তমান তাে সাহিত্যের পরতে পরতে লীন হয়ে থাকে সর্বদাই । ভাবের বিষয়কে ভাষার , অন্তরের বিষয়কে বাইরের , নিজের বিষয়কে সমষ্টির সঙ্গে ভাগ করে নিতে সাহিত্য পাঠের আনন্দ লাভ জরুরি ।
বই পড়ার আনন্দ / সাহিত্য পাঠের আনন্দ
Sahitto Parter Anondo
Tag: সাহিত্য পাঠের আনন্দ রচনা - সাহিত্য পাঠের আনন্দ, Sahitto Parte Anondo Rochona, সাহিত্য পাঠের আনন্দের গুরুত্ব, সাহিত্য পাঠের আনন্দ অনুচ্ছেদ রচনা, সাহিত্য পাঠের আনন্দ বলতে কি বোঝায়,রচনা - সাহিত্য পাঠের আনন্দ
Any business enquiry contact us
Email:-Educationblog24.com@gmail.com
(সবচেয়ে আগে সকল তথ্য,গুরুত্বপূর্ণ সকল পিডিএফ, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদেরGoogle News,FacebookএবংTelegram পেজ)