দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা রচনা
ভূমিকা : বাংলাদেশে মােট জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে নারী । তাই দেশের সুষম আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ জাতীয় উন্নয়নে নারীর সমান অংশগ্রহণের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । জীবনধারনের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় সব কাজ অর্থাৎ গৃহস্থালি বা সাংসারিক কর্মকাণ্ডের বােঝা বহন করা , সন্তান ধারণ এবং মা হিসেবে । ভবিষ্যতের উপযুক্ত নাগরিক ' গড়ে তােলাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে নারীসমাজ । তারই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি মেলে মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতায় -
‘ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর , অর্ধেক তার করিয়াছে নারী , অর্ধেক তার নর ।
বাংলাদেশে নারীর অবস্থান : সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীর ভূমিকা ও অবদান স্বীকৃতি পেলেও সার্বিকভাবে উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি । শিক্ষার অভাবে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না । পুরুষশাসিত প্রথাবদ্ধ সমাজে নারীরা লিঙ্গবৈষম্য , সামাজিক নিপীড়ন ও বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার । জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা খুবই সীমিত । ব্যাপক সংখ্যক নারী এখনও অবরােধপ্রথার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি । অশিক্ষা , দারিদ্র্য ও প্রথাবদ্ধ ধ্যান - ধারণার কারণে নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারছে না , তারা পুরুষের ওপর নির্ভরশীল । হত্যা , ধর্ষণ , শারীরিক নির্যাতন , অ্যাসিড নিক্ষেপের মতাে নির্মম ঘটনার শিকার অসংখ্য অসহায় নারী । সংবিধানে নারী পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত হলেও ধর্মীয় ও পারিবারিক আইনে নারীর সার্বভৌমত্ব ও সমানাধিকার স্বীকৃত নয় । শিক্ষা ক্ষেত্রে , চাকরির ক্ষেত্রে এবং প্রাতিষ্ঠানিক - অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা সুযােগ - সুবিধার ক্ষেত্রে নারী সমাজ প্রতিনিয়তই বঞ্চিত । সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন আন্দোলন - সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজে সচেতনতা বাড়ছে । শিক্ষা ক্ষেত্রে , অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমশ বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ ।
নারী আন্দোলন ও নারী উন্নয়ন : মােট জনসংখ্যার অর্ধেক হিসেবে নারীসমাজ অর্ধেক জনশক্তির প্রতিনিধি । এ নিশাত পশ্চাৎপদ , অশিক্ষিত এবং অসচেতন থাকলে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয় । এ উপলব্দি থেকেই । নারীসমাজকে সচেতন করে তুলতে , সমাজের নানান অদৃশ্য শৃঙ্খল থেকে নারীদের মুক্ত করতে এবং নারীর । মতায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে বিভিন্ন নারী সংগঠন । ফলে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও রাষ্ট্র । ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে নারীর অধিকার ও স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে । ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় ১ ম বিশ্ব নারী সম্মেলন । ১৯৭৬-৮৫ সাল ১ ম নারী দশক হিসেবে ঘােষণা করে প্রতিটি দেশে নারীর স্বার্থ । সংরক্ষণে জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন সংস্থায় নারী ইউনিট গড়ে তােলার সুপারিশ করে জাতিসংঘ । ফলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকার নারী উন্নয়ন বিভাগ বা নারী মন্ত্রণালয় চালু করে । আশির দশকের শেষে জাতিসংঘ , বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দাতা সংস্থায় নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়নে নারী বিভাগ চালু হয় । জাতিসংঘের দ্বিতীয় উন্নয়ন দশক ( ১৯৭০-৮০ ) থেকে নারী ইস্যু এবং উন্নয়নে নারী আন্দোলনটি বিকাশ লাভ করে ।
জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা : নারী সমাজের হাতে যেমন থাকে পরিবারের চাবি , তেমনি জাতীয় জীবন গঠনের মূল চাবিকাঠিও নারীর হাতেই বিদ্যমান । শিশুর চরিত্র গঠনে মায়ের ভূমিকাই প্রধান । সচেতন নারীর পক্ষেই সম্ভব সমাজকে সুযােগ্য সন্তান উপহার দেয়া । এছাড়া সংসারের ভালােমন্দ সবকিছুর প্রতি নজর রেখে নারী স্বামীকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে ব্যাপকভাবে । জাতীয় উন্নয়ন মানে সমাজের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন । এক্ষেত্রে তাই পরিবারে নারীর এ ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । সেই লক্ষ্যে একজন নারীকে অবশ্যই শিক্ষিত এবং সচেতন নাগরিক হতে হবে । কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা তাদের স্বীয় মেধা ও যােগ্যতার ভিত্তিতে পুরুষের কাধে কাধ মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে । বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নারীদের সদর্প উপস্থিতি তারই প্রমাণ বহন করে । শ্রমিক ও কর্মজীবী নারীদের অধিকাংশই কাজ করছে পপাশাকশিল্পে । এর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামীণ অর্থনীতি - নির্ভর কর্মকাণ্ড , পরিবহন , শিক্ষকতা , বিপণন , বিপণিকেন্দ্র ইত্যাদিতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে । তাছাড়া আইনজীবী , সাংবাদিকতা , আইন প্রয়ােগকারী বাহিনী ইত্যাদি চ্যালেঞ্জিং পেশাতেও নারীরা যুক্ত হচ্ছে । নানা পেশায় নারীর এই অংশগ্রহণ যত বাড়বে , একটি সুদৃঢ় জাতি গঠনের পথে আমরা ততই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব ।
নারীর অদৃশ্য অবদান ; জীবনধারণের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় সব কাজ যেমন , গৃহস্থালি অর্থাৎ সাংসারিক কর্মকাণ্ডের বােঝা বহন করে নারীসমাজ । জাতীয় অর্থনীতিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । কিন্তু অর্থনৈতিক মূল্য নেই বলে তা স্বীকৃতিহীন । গৃহশ্রম তাই জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না । ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে , নারীরা সংসারে যে কাজ করে তার মূল্য দিতে হলে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বিশ্বের মােট উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যাবে বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ । জাতীয় উন্নয়নে নারীর এ অবদানও ছােট করে দেখার কোনাে অবকাশ নেই ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজ : বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম বাঙালি জাতির পরিচয় । জাতি গঠনে নারীসমাজের কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে এসে যায় মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজের গৌরবােজ্জ্বল অবদানের কথা । মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজ নানাভাবে অংশ নেয় । যুদ্ধের শুরুতে প্রতিটি অঞলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তাতে মহিলা ও ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল । তারামন বিবি , কাকন বিবি , রহিমা বেগমসহ নাম জানা অনেক নারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন । অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন , আহার যুগিয়েছেন , আহত মুক্তিযােদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা করেছেন । জীবন বাজি রেখে হানাদার বাহিনী সম্পর্কে গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেছেন । মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে সম্রম হারিয়েছেন প্রায় দুই লক্ষ নারী । নারীর এ আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির কাছে এক বিশাল ঋণ । শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরােধী - মুক্তি আন্দোলন , ভাষা আন্দোলন , স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এদেশের নারীসমাজের বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে ।
জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় । নারীর ভূমিকা এখনও সীমিত । তাই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীসমাজ নানা প্রতিকূলতার । সম্মুখীন । এর মধ্যে রয়েছে
১. শ্রমবাজারে নারীর সীমিত প্রবেশাধিকার ;
২. কাজে নিয়ােগের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার ; ৩. মজুরি বৈষম্যের শিকার ;
৪. গণতন্ত্রে নারীর অধিকার এখনও অবিকশিত ;
৫. সঠিক সমন্বয়হীনতার অভাবে গ্রামাঞ্চলে নারীর স্বকর্মসংস্থানের অনেক কর্মসূচি নারীর কাছে পৌছায় । ;
৬. সামাজিক অবস্থান ও মানসিক দৈন্য এখনও শিক্ষা থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ;
৭. ফতােয়াবাজ মৌলবাদীদের অপতৎপরতার শিকার হচ্ছে নারীরা এখনও ।
প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায় : বাংলাদেশে জাতীয় উন্নয়নের সাথে জড়িয়ে আছে নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি । ক্ষমতায়ন অর্থাৎ বস্তুগত , মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই নারীসমাজ অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে । আর এর মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব । শ্রমবাজারে নারীর সমান প্রবেশাধিকার ও সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে । শিক্ষার সুযােগ পৌছে দিতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে । সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ও গণতন্ত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে । ফতােয়াবাজদের অপতৎপরতা বন্ধ করে সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে নারীকে সচেতন করতে হবে । সর্বোপরি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে ।
উপসংহার : দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সমাজ , পরিবার ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অর্থবহ অংশগ্রহণের কোনাে বিকল্প নেই । তাই নারীর জন্য সুশিক্ষার সুযােগ সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা যেন নিঃশঙ্কচিত্তে নিজেদের যােগ্যতার পরিচয় রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে । গঠনে নারীর ভূমিকার যথাযােগ্য মূল্যায়ন করে নারীকে তার যথার্থ সম্মান এবং উপযুক্ত সহযােগিতা করার দায়িত্ব আমাদের সবার ।
দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা
Desh Ghotone Narisomajer Vumika
Tag: দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা রচনা - দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা, Desh Ghotone Narisomajer Vumika Rochona, একবিংশ শতাব্দীর নারী সমাজ, দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা অনুচ্ছেদ রচনা, রচনা - দেশগঠনে নারীসমাজের ভূমিকা
Any business enquiry contact us
Email:-Educationblog24.com@gmail.com
(সবচেয়ে আগে সকল তথ্য,গুরুত্বপূর্ণ সকল পিডিএফ, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদেরGoogle News,FacebookএবংTelegram পেজ)