জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রচনা
ভূমিকা :
“ পরাজিত শক্তি যখন হেঁটে বেড়ায় বিজয়ীর. বেশে , যখন ফুলেরা কাঁদে , হায়েনারা হাসে ; যখন মানুষ ঘুমায় , পশুরা জাগে ; তখন আমার ঠিকানায় আসে সেই পুরনাে পত্র , তখন আমার কানে ভাসে সেই পুরনাে ছত্র— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার.. সংগ্রাম ! জয় বাংলা ! ”
কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলতে গেলে ঠিক এমনই- বাঙালি জাতি যখনই সংকটাপন্ন হয় তখন যে ছয় কানে ভাসে আর সেই ছত্রের সাথে যে নাম আমাদের স্মরণে আসে তা হলাে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । আমাদের এই দেশ , এই জাতির অস্তিত্বই পৃথিবীর বুকে গর্বভরে উচ্চারিত হতাে না যদি এই নামটি না থাকত । বাংলার মাটি যে বাঙালি অমর নেতার জন্মে ধন্য হয়েছে , তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি উচ্চারণ করতে গেলেই যে শব্দ দুটি প্রথমে উচ্চারণ করতে হয় তা হলাে জাতির জনক ’ ও ‘ বঙ্গবন্ধু ' । মূলত এই দুটি শব্দ দিয়েই তার পরিচয় । অবদান , আমাদের সামনে উঠে আসে । বিশ্বে যে সকল দেশ স্বাধীন হয়েছে তার কিছু কিছু দেশে স্বাধীনতার জন্য এক একজন মহীরূহ সদৃশ দেশনেতা অবদান রেখেছেন । বিশ্ব ইতিহাসের এই মহান ব্যক্তিদেরই একজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বাঙালি জাতির এক মহাসন্ধিক্ষণে । এই মহান ব্যক্তির নেতৃত্ব লাভ করে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতি । তাঁর উদাত্ত আহ্বানেই বাঙালি অংশ নেয় গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অর্জন করে বহু প্রত্যাশিত স্বাধীনতা ।
ব্যক্তিগত পরিচয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান ও মাতার নাম সায়েরা খাতুন । ছয় ভাইবােনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন । তৃতীয় । বাবা - মা ডাকতেন ‘ খােকা ' বলে ।
শিক্ষাজীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : সাত বছর বয়সে টুঙ্গিপাড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় । নয় বছর বয়সে গােপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন । পরে তিনি স্থানীয় মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন । ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে গােপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স ( এসএসসি ) পাস করেন । তারপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন । ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন । এরপর তিনি সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন । কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তার আর পড়া হয়ে ওঠেনি ।
বৈবাহিক জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা । তিন পুত্র শেখ কামাল , শেখ জামাল ও শেখ রাসেল ।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলন : ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন । তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ফেডারেশনে যােগ দেন এবং এক বছরের মধ্যে বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন । সে বছরই তিনি গােপালগঞ্জ ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি হন । এভাবে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন । ১৯৪৮ সালে তিনি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদ - ই - আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিলে বজাবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তােলে । ফলে তাকে দু’বছর জেলে থাকতে হয় । জেলখানায় থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন ও উৎসাহ দেন । ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত পাকিস্তান সরকারের দুইবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন । ১৯৫৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাকে গৃহবন্দি করে রাখা । হয় । ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা কর্মসূচি পেশ করেন । ১৯৬৯ সালে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র । মামলার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের নামে প্রহসন করতে থাকে । তখন সারা বাংলায় ছাত্র - জনতার তীব্র গণ - অভ্যুত্থানের কারণে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং ১৯৬৯ । সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়ােজিত রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের নাগরিক সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ' বঙ্গবন্ধু ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় বরং পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় । ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দান- বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে ভাষণ দেন তাতেই বাংলার মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে । তাঁর একটি ডাকে দেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে । আর সেটি ছিল স্বাধীনতার ডাক । পাকিস্তানি সরকারের কাছে গ্রেফতারের পূর্বে ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন । তার এই ডাকেই বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ অর্জন করে । ১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল মুজিবনগরে । বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় । এই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারি তিনি বাংলার মাটিতে পা রাখেন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে জাতির জনক ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল— “ শেখ মুজিব ঢাকা বিমানবন্দরে পদার্পণ করামাত্র নতুন প্রজাতন্ত্র এক সুদৃঢ় বাস্তবতা লাভ করে । ” স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়টুকু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর ব্লহমান । যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে তাঁর সরকারকে অগণিত সমস্যা মােকাবিলা করতে হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং জাতিগঠনে কার্যক্রম শুরু হয় । আইন - শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা , অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলাে লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা । স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা হয় । পনেরাে মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । একশত চল্লিশটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় । বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পথ নির্দেশনা নির্ধারণ করেন , “ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয় । " বস্তুত মুজিব সরকারই গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলাের সূচনা করেন ।
আদর্শ ও দেশপ্রেমের প্রতিকৃতি : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা । শৈশব - কৈশাের থেকে তিনি এই আদর্শ নিয়েই বড় হয়েছেন । এক অদ্ভুত চারিত্রিক দৃঢ়তার অধিকারী ছিলেন তিনি । তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তার পেছনে ছিল গভীর অধ্যয়ন , জানা চেনা - শােনা ও দেখার গভীর অন্তর্দৃষ্টি । তার ছিল মানুষকে ভালােবাসা ও সাহায্য করার জন্য দরদি মন । মানুষের দুঃখ তাকে চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলতাে , তাকে আবেগতাড়িত করত । আর সেজন্যই বাঙালি জাতির ভাগ্যকে জয় করতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনের প্রতি তাকিয়ে দেখার সুযােগ পাননি । দেশেরে জন্য জেল 1 জুলুম , রাজনৈতিক ষড়যন্ত , শাসকগােষ্ঠীর অত্যাচার সবকিছু সহ্য করেছেন । কিন্তু বাংলার মানুষের সাথে কখনাে । বিশ্বাসঘাতকতা করেননি । তার লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের মুক্তি । একজন মহান নেতা হবার সবকটি গুণই । আমরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পাই ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের কালাে অধ্যায় : স্বাধীন বাংলাদেশে পথভ্রষ্ট কিছু সংখ্যক সামরিক আমলা , ক্ষমতালােভী দেশবিরােধীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে । এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কালাে অধ্যায়ের সূচনা হয় । বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কেবল ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা নয় , বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড । এই অবিসংবাদিত নেতাকে যে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল , এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালাে অধ্যায় । কবির ভাষায়—
“ আমরা বাহান্নতে মরেছি দলে দলে , আমরা একাত্তরে মরেছি ঝাঁকে ঝাঁকে , আমরা পঁচাত্তরে মরেছি সপরিবারে । ”
উপসংহার : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান । এই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের যথার্থ উচ্চারণ : “ যতদিন রবে পদ্মা - মেঘনা / গৌরী - যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তােমার / শেখ মুজিবুর রহমান । ” তাঁর কীর্তি ও অবদান বলে শেষ করার নয় । তার নাম বাংলার মাটিতে , বাংলার কথায় , বাঙালির জাতি স্বভায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মজীবনী
Jatir Jonok Bonggobondhu Sheikh Mujibur Rahman Rochona
Tag: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রচনা - জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, Jatir Jonok Bonggobondhu Sheikh Mujibur Rahman, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মজীবনী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মজীবনী অনুচ্ছেদ রচনা